বছরজুড়ে বিভিন্ন সরকারি অফিসে ফাঁদ পেতে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তারে ‘রেকর্ডও’ গড়ে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি।
কিন্তু বিপরীত দিকে দুর্নীতির নিয়মিত মামলায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা যেমন আগের বছরের চেয়ে কমেছে, তেমনি মামলা, আদালতে অভিযোগপত্র ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ভাটার টান।
মামলা ও তদন্তের ধীর গতির জন্য সর্বোচ্চ আদালতের কটাক্ষও শুনতে হয়েছে দেশের দুর্নীতি দমন সংস্থাটিকে।
দুদক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ফাঁদ পেতে ৩৯ আসামিকে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়, ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৩ জন। আর ২০১৫ সালে চার ও ২০১৪ সালে পাঁচ জনকে ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তার করে দুদক।
২০১৬ সালের তুলনায় এ বছর নিয়মিত মামলায় আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে যেখানে মোট ৩৮৮ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেখানে এবছর গ্রেপ্তার ১৭৯ জন।
তবে বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তারের খবর বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল।
এদের মধ্যে ১৮ জুলাই নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে ১ জুলাই সিটিসেলের সিইও মেহবুব চৌধুরী, ৮ জানুয়ারি সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা অঞ্চলের এস্টেট ও আইন কর্মকর্তা উপ-সচিব মো. মিজানুর রহমানকে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে দুদক।
এছাড়া ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এইচএম তায়েহীদ জামানসহ তিন কর্মকর্তা, ৯ ফেব্রুয়ারি রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল উদ্দিন চৌধুরী, হাওর রক্ষা বাঁধ দুর্নীতির মামলায় ২ জুলাই সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দীনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এবছর দুর্নীতির অভিযোগে কমিশন ২২২টি মামলা করে, আগের বছর মামলার পরিমাণ ছিল ৩৩৯টি। ২০১৬ সালে ৫২৮টি মামলার অভিযোগপত্র দিলেও ২০১৭ সালে তা কমে ৩৫৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
একই সাথে আগের বছর ৫০০ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও ২০১৭ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ২২৫টি হয়েছে।
এই বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, “অন্যান্য বছরের মত মামলা দায়েরের দিকে এবার বেশি মনোযোগ না দিলেও গুণগত ও তথ্য-উপাত্তের দিকে মনোযোগী হয়ে কমিশন মামলা করার কারণে এমনটা হয়েছে। তাছাড়া দুর্নীতি দমনের চেয়ে দুদকের প্রতিরোধমূলক কাজে বেশি মনোযোগী থাকাটাও মামলা ও গ্রেপ্তার কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ।”
এবছর দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মোট ২৮৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে এক হিসেবে জানিয়েছে দুদক। এর মধ্যে ১৬৯টি মামলায় সাজা ও ১১৯টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন; নভেম্বর পর্যন্ত সাজার হার ৫৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দুদকে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা তিন হাজার ৪১৮টি, যা ২০১৬ সালে ছিল তিন হাজার ৩৫৯টি। এ সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতের আদেশে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ৫৮৭টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে; এই সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ৬৬৮টি। এছাড়া নভেম্বর পর্যন্ত উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ৬৫১টি মামলার উপর স্থগিতাদেশ রয়েছে বলে দুদক জানিয়েছে।
নতুন উদ্যোগ
এ বছরের শুরুতে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রথম বারের মত পাঁচ বছর মেয়াদী ‘কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা’ হাতে নেয়, যার ধারাবাহিকতায় বছরের মাঝামাঝিতে ‘হটলাইন ১০৬’ চালু করে। এছাড়া বছরটিতে নিজস্ব হাজতখানা, সশস্ত্র পুলিশ ইউনিট, গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করেছে সংস্থাটি। এসব উদ্যোগ দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে মনে করে দুদক।
‘হটলাইন ১০৬’ দেশব্যাপী সারা ফেলেছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই হটলাইন নিয়ে সংবাদও হয়েছে।
জুলাইতে চালু হওয়া হটলাইনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই পর্যন্ত কয়েক লাখ অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান, ফাঁদ মামলা পরিচালনা ও বেশ কিছু অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
এবছর দুদকের ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’ রাজধানীর বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষকের বদলি, কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ৯৭ জন শিক্ষকের শাস্তি, প্রশ্নফাঁস হওয়াসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস তুলে ধরে সরকারের কাছে ৩৯টি সুপারিশ করেছে। দুদকের এই উদ্যোগটি বছরের শেষ দিকে আলোচনায় উঠে আসে।
এবার হাওর অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি কারণে সৃষ্ট অসময়ের বন্যায় কৃষকের ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে, এই নিয়ে দুদকের উদ্যোগ বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জের হাওরে ২৮টি বাঁধ নির্মাণ না করে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২ জুলাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এছাড়া পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে কমিশন।
অবশেষে বেসিকের বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ
আলোচিত বেসিক ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৫৬টি মামলা হলেও কোনোটিতেই ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি।
চার বছর আগে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে অভিযোগের মুখে থাকা বাচ্চুকে এবছরই দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমবারের মত গত ৪ ডিসেম্বর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদক নতুন করে ২০১৮ সালে আরো কিছু মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
পুরনো ও নতুন মামলায় আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামি করার মতো যৌক্তিক তথ্য তদন্তে পাওয়া গেছে বলে দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দুর্নীতির অভিযোগে বছরব্যাপী দুদকের বিভিন্ন কার্যক্রম চললেও অপেক্ষাকৃত ছোট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে নাগরিক সমাজ থেকে অভিযোগ রয়েছে।
তবে বিষয়টি অনুধাবন করে বছরের শেষ দিকে গত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবসের আলোচনায় সভায় ‘বড় দুর্নীতিবাজদের’ তালিকা করে ২০১৮ সাল থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন চেয়ারম্যান।
একে/এম