সিটিজি জার্নাল নিউজঃ সরকারের হিসাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু এই হিসাবের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিশ্বব্যাংকসহ আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, এই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এই পূর্বাভাস সরকারের হিসাবের চেয়ে এক শতাংশ কম। অবশ্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবে, এই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ অর্জিত হতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, এই অর্থবছরে সাত দশমিক এক শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।
এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব বেশি ভাবনা না থাকলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে। বিনিয়োগ-উৎপাদন, আয়-উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ে। মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জিডিপির যে পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে, তা সরকারের হিসাবের চেয়ে এক শতাংশ কম।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের কাছাকাছিই হবে। ৭ শতাংশের ওপরে যাবে না। কারণ, বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে আমদানি বাড়ছে। আর এই ধরনের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমাতে সহায়ক হয়।
এছাড়া এটা নির্বাচনি বছরও। রফতানি প্রবৃদ্ধি মোটেও যথেষ্ট ছিল না। এটা অব্যাহত থাকবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। তবে রেমিটেন্স এখন ভালো। এই রেমিটেন্স আগামী দিনগুলোতেও ভালো হবে কিনা, তা দেখতে হবে। কারণ, সৌদি আরবে ইদানিং নানা ধরনের সমস্যা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদও মনে করেন, ‘এই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নাও অর্জিত হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছরের মধ্যে এবার বড় বন্যা হয়েছে দেশে। এতে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, ব্যাপক ফসলহানিও হয়েছে। যখন সরকার বাজেট উপস্থাপন করেছিল, তখন বন্যার ক্ষতির বিষয়টি হিসাবে ছিল না। এর সঙ্গে নির্বাচনের বছর হওয়ায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বন্যার কারণে উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। বিশেষ করে গরিবদের ব্যয় বাড়ছে, সঞ্চয়ও কমছে। আবার আমাদানি খরচ বাড়ছে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কত শতাংশ হবে, সেটা বছর শেষ হলেই কেবল বলা সম্ভব, তার আগে নয়।’
হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যা ও এরপর দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে কৃষি খাতে যে ক্ষতি হয়েছে, তার একটা প্রভাব এই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে পড়তে পারে বলে মনে করেন, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক আগের অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধি কম বলেছিল, কিন্তু পরে তো বাড়ালো। বিশ্বব্যাংক যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, পরে আবার সেখান থেকে সরেও গেল। কেবল এই অর্থবছরের ৫ মাসের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পুরো অর্থবছরের পূর্বাভাস দেওয়া ঠিক হবে না।’
এদিকে বিশ্বব্যাংকের জিডিপির পূর্বাভাসকে পাত্তা দিতে চান না বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক জিডিপির পূর্বাভাস সব সময়ই কম করে বলে থাকে। আমার মনে হয় না, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ঠিক আছে। তারা কিন্তু তাদের পূর্বাভাস পরিবর্তন করে। গত কয়েক বছর ধরে তারা প্রথমে একটা বলে, পরে আরেকটা বলে। শেষে গিয়ে সরকার যেটা বলে, সেটাই তারা নেয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘গত অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক ৬ দশমিক ৮ শতাংশের কথা বলেছিল। প্রথমে তারা ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছিল। এরপর বলেছিল, ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, এরপর তারা ৬ দশমিক ৮ শতাংশের পূর্বাভাস দিয়েছিল। এ কারণে তাদের এই পূর্বাভাসে কোনও কিছু আসে-যায় না।’
মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাসে যা-ই বলুক না কেন, বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির কারণে আমাদের হয়তো একটু রিকভার করতে হবে। তবে সাধারণত বন্যায় পলিমাটি আসার কারণে বন্যার পরে উৎপাদন বাড়ে। এ জন্য আমাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হবে। সেক্ষেত্রে প্রথমত, বন্যায় কৃষি খাতে ক্ষতির বিষয়টিকে হয়ত বিশ্বব্যাংক আমলে নিয়েছে। আবার কৃষির ক্ষতি মোকাবিলায় খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, রফতানি প্রবৃদ্ধি এখন পর্যন্ত যে অবস্থায় আছে, তা ধরে রাখা যাবে কিনা, সেটাও দেখার বিষয়। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে এর নিম্নমুখী একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। একইভাবে রেমিটেন্সের প্রবাহ ধরে রাখা যাবে কিনা, সেটাও দেখার বিষয়। প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হতে পারে, তার আরেকটি কারণ, সামনে জাতীয় নির্বাচন। আর নির্বাচন সামনে থাকলে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগও শ্লথগতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিশ্বব্যাংক যেটাই বলুক, শেষ পর্যন্ত সরকারি হিসাবকে তারা আমলে নেয়। ’
অবশ্য বিশ্বব্যাংকের আগের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘বরাবরই বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের হিসাবের চেয়ে একটু কমিয়ে পূবার্ভাস দেয়। এটা তাদের মতো করে তারা দেয়। অর্থবছর শেষ হলে আবার ঠিকটাও দেয়। যেমনটি হয়েছে গত অর্থবছরে। এ কারণে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। দেশে এমন কিছু ঘটেনি যে, এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।’
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার প্রকাশিথ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় ব্যক্তিপর্যায়ে ভোগ কমবে। একইসঙ্গে কমবে বিনিয়োগও। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমবে বাংলাদেশের।’
এদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাব বলছে, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন। সরকার ওই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ০ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি অর্জিত হয়েছে। গত অর্থবছর চূড়ান্ত হিসাবে বাংলাদেশের মোট জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৯৮৬ কোটি ডলার বা ২০ লাখ ৮৭ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।
বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় একদশক ধরে দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে ছিল। প্রথমবারের মতো ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৭ শতাংশ অর্জিত হয়। ওই বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। আর গত অর্থবছর তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এর আগে এডিবি তাদের ‘ডেভেলপমেন্ট আউটলুক আপডেট-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা হলেও শ্লথ হতে পারে। এডিবি’র হিসাব অনুযায়ী, এই অর্থবছরে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আবার আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে সাত দশমিক এক শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।
একে/এম
Powered by : Oline IT