সিটিজি জার্নাল ডেস্কঃ শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা জারি করলেও সার্বিকভাবে কোচিং সেন্টার বন্ধে কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশেই গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন কোচিং সেন্টার। সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে চাইলেই মিলছে কোচিং সেন্টারের লাইসেন্স। এসব সেন্টারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষা নিয়ে এভাবে ব্যবসা বা কোচিং সেন্টার করার বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা চলতে পারে না। ২০১২ সালের নীতিমালায় বিষয়টি স্পষ্ট করা না হলেও সাধারণ আইনের মাধ্যমে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।’ প্রয়োজনে নতুন আইন বা নীতিমালা করার তাগিদ দেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে একটি রিট আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে সরকারকে নীতিমালা করার নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ জারি করে। ওই নীতিমালায় শিক্ষকদের কোচিং বন্ধের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী কোনও শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। কিন্তু এ নীতিমালার কোথাও বেসরকারি পর্যায়ে কেউ কোচিং সেন্টার স্থাপন বা পরিচালনা করতে পারবে না–এমন শর্তারোপ করা হয়নি। প্রচলিত আইনেও কোচিং সেন্টার পরিচালনার বিষয়ে কিছু বলা নেই।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে হবে। বাস্তবায়ন করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও আইনি কোনও কাঠামো নেই, এ কারণে কোচিং সেন্টার বন্ধ করা যাচ্ছে না।’
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০১২ সালের ওই নীতিমালায় শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার কথা বলা হলেও কোচিং সেন্টার বা কেচিং বন্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়নি।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বলেন, ‘প্রচলিত আইনে কোচিং সেন্টার বন্ধের নির্দেশনা না থাকলেও শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য অন্যয়। শুধু শিক্ষক নয়, শিক্ষা নিয়ে কারও সরাসরি বাণিজ্য করার অধিকার নেই। যদি শিক্ষার পরিবেশ ও শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, তাহলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। লাইসেন্স দেওয়া বন্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, ‘কোচিং সেন্টার বন্ধের বিষয়ে এখনও আমাদের কাছে কোনও নির্দেশনা আসেনি। তাই এগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।’ একই কথা জানান দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসূফ আলী সরদার। তিনি বলেন, ‘সব অঞ্চলেই কোচিং সেন্টার করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।’
সম্প্রতি রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের পাশে সায়েন্স ল্যাব এলাকার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে বেশকিছু কোচিং সেন্টারের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব কোচিং সেন্টারের সঙ্গে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের দু’একজন শিক্ষক জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা। এ বিষয়ে হলি একাডেমি নামের একটি কোচিং সেন্টারের কর্মকর্তা নাসির বলেন, ‘আগে একজন স্কুলশিক্ষক আমাদের কোচিং সেন্টারে ছিলেন। তবে এখন কোনও শিক্ষক নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে আমরা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করছি।’ অন্য কোনও কোচিং সেন্টারের সঙ্গে কোনও শিক্ষক জড়িত কিনা তা জানেন না বলেও জানান তিনি।
গত ৫ ডিসেম্বর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বৈগর গলির একটি বাসায় গিয়ে যায়, সেখানে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. ফারহানা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করছেন। বাসাটির দুটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের কোচিং ক্লাস করতে দেখা যায়। তবে কোথাও কোচিং সেন্টারটির নাম দেখা যায়নি।
জানা যায়, রাজধানীর অনেক জায়গায় এভাবেই সাইনবোর্ড, ব্যানার কিছু ব্যবহার না করে গোপনে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষক। মোহাম্মদপুরের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক পুরবী বেগম বলেন, ‘অনেক শিক্ষকই কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। আমার ছেলেকেও কোচিং করিয়েছি।’ অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, প্রশাসনের চাপাচাপি না থাকলে স্থানীয় স্কুল বা কলেজের শিক্ষকদের দিয়েই কোচিং করানো হয়।
এদিকে, রাজধানীর বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে দেশের ‘সেরা শিক্ষকদের দিয়ে কোচিং সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে’ উল্লেখ করা হলেও কোনও কোচিং সেন্টারে গিয়ে শিক্ষকদের তালিকা পাওয়া যায়নি। দু-একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকের তালিকা পাওয়া গেলেও তাদের সেখানে পাওয়া যায়নি।
শিক্ষদের কোচিং এবং সার্বিকভাবে কোচিং সেন্টারের বিরোধিতা করে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘শুধু শিক্ষকদের কোচিং বন্ধ করলেই হবে না। কোচিং সেন্টারও বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে এক শ্রেণির মানুষ। এতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। প্রয়োজনে আইন করে বা আরও একটি নীতিমালা করে এটি বন্ধ করা উচিত।’
Powered by : Oline IT