গত চার বছর বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব চালিয়ে আসা মেননকে এবার দেওয়া হয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আগের মন্ত্রীর মৃত্যুতে এ মন্ত্রণালয় বেশ কিছুদিন ধরে একজন প্রতিমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে চলছিল।
রাশেদ খান মেননের সময়ে বিমান মন্ত্রণালয় প্রথমবার বড় ধাক্কা খায় ২০১৬ সালের মার্চে। নিরাপত্তা ঘাটতির কারণ দেখিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কার্গো বিমানের (পণ্যবাহী উড়োজাহাজ) সরাসরি ফ্লাইট নিষিদ্ধ করে যুক্তরাজ্য।
এর ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের যুক্তরাজ্যে পণ্য পাঠাতে হলে প্রথমে সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড কিংবা দুবাই নিতে হচ্ছে, তারপর সেখান থেকে পাঠাতে হচ্ছে যুক্তরাজ্যে। ফলে সময় ও খরচ দুটোই বেড়ে গেছে।
গত ডিসেম্বরে মেনন বলেছিলেন, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থাই তারা নিয়েছেন। নতুন বছর শুরুর আগেই যুক্তরাজ্য ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে।
কিন্তু মন্ত্রীর সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাজ্য নতুন করে ১০টি শর্ত দিয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবর।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ইনামুল বারী ডিসেম্বরের শেষ দিকে বলেন, “সবার প্রত্যাশা ছিল এ বছরই নিষেধাজ্ঞা ওঠে যাবে। তা হলে বিমান আরও বেশি মুনাফা করতে পারত। গতবছর মুনাফার ওপর এটা যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে মুনাফার পাশাপাশি সুনামও বাড়ত।”
বিমানের আয়ের অন্যতম খাত হল কার্গো পরিবহন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে যেখানে ৩১৫ কোটি টাকা আয় হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞার পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ২৪৪ কোটি টাকায় নেমে আসে।
এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বিমানের নিট মুনাফায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ২৩৫ কোটি টাকা থেকে কমে পরের অর্থবছরে নিট মুনাফা হয় ৪৭ কোটি টাকা।
বিমানের একজন কর্মকর্তা বলেন, “মন্ত্রী আশা দিয়েছিলেন, যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। অনেকেরই এটা খারাপ লেগেছে।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন বসিয়ে রাখায় কয়েকশ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে বিমানকে। ওই বিষয়টিও লাভ কমার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ওই উড়োজাহাজ দুটি ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
মেনন মন্ত্রী থাকার সময়ই ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী একটি বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণে বাধ্য হয়। সে ঘটনা পুরো দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে; কেউ কেউ সে সময় বিমানমন্ত্রী মেননের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার অভিযোগ তোলেন এবং তার পদত্যাগেরও দাবি তোলেন।
অস্থায়ী কর্মীদের চাকরি স্থায়ী করার আশ্বাস দিলেও বছরের পর বছর তার বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিমান এবং সিভিল এভিয়েশনের কর্মচারীদের মধ্যে মন্ত্রীকে নিয়ে অসন্তোষ ছিল বলে একাধিক কর্মকর্তা জানান।
যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা, বিমানে ত্রুটি আর জঙ্গি ঝুঁকির প্রেক্ষাপটে নানাভাবে নিরাপত্তা বাড়ানোর পরও ২০১৬ সালের নভেম্বরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক আনসার সদস্য ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
গতবছর সেপ্টেম্বরে হজ মৌসুমের মধ্যে বিমানবন্দরের মূল ভবনে আগুন লাগলে তিন ঘণ্টা বহির্গমন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পরে তদন্তে দেখা যায়, বাংলাদেশের বৃহত্তম বিমানবন্দরটিতে আগুন নেভানোর অত্যাধুনিক কোনো যন্ত্রপাতিই নেই।
সরকার যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান নিয়ে এগোচ্ছে, বিদেশি পর্যটক টানতে যেখানে তিন বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, সেখানে দেশের বিমানবন্দরগুলোর কার্যক্রম চলছে অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ছাড়াই।
বিমানবন্দরগুলোর নিজস্ব কোনো ওয়েবসাইট যে নেই- সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী মেনন নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার অনেক বিষয়েই তিনি ‘অবগত নন’ বলে সমালোচনা রয়েছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হতে দেরি হওয়ায় গত ডিসেম্বরে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
ওই কমিটির সভাপতি সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খান সে সময় বলেন, সিভিল এভিয়েশনের বেশিরভাগ প্রকল্প শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। এজন্য সিভিল এভিয়েশনকে সতর্ক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটির এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “মন্ত্রী (রাশেদ খান মেনন) প্রয়োজনে কঠোর হতে পারেননি। এর সুযোগ অনেকেই নিয়েছে।”
মন্ত্রী বদলের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এসএম নাসিমুল হক বলেন,“বিমানমন্ত্রী কে এল বা কে গেল তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না আসলে। কারণ স্ট্রাকচারাল কোনো পরিবর্তন তাতে হয় না।”
মন্ত্রিসভায় রদবদলের পর বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন রাশেদ খান মেনন। দপ্তর বদলের পেছনে প্রধানমন্ত্রীর বিমানে ত্রুটির বিষয়টি বা কোনো ব্যর্থতা ভূমিকা রেখেছে কি না- এমন প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয় তাকে।
জবাবে মেনন বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিমানের যে ঘটনা ছিল, আমরা তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। কিছু অবহেলার কারণে এটা হয়েছিল। পুলিশ তদন্ত করে যাদের গ্রেপ্তার করেছিল, তাদের পরে খালাস দেওয়া হয়েছে। পুলিশের তদন্তে বলা হয়েছে, তারা নাশকতার সঙ্গে যুক্ত নয়।”
গত চার বছরে সিভিল এভিয়েশন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে কাজ করা যে ‘খুব চ্যালেঞ্জিং’ ছিল, সে কথাও বলেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেনন।
তিনি বলেন, “বছরের প্রথমভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার যে সম্প্রসারণ করলেন ও পরিবর্তন সাধন করলেন, আমার মনে হয় স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনে গতিশীলতা আনার জন্য করলেন। এটিই হচ্ছে শেষ বছর আমাদের সরকারের। সুতরাং তিনি চেয়েছেন শেষ বছরের কাজের সমন্বয় আরও ভালোভাবে যেন হয়।”
আর নিজের দপ্তর পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার জন্য সুখকর এই কারণে বলতে পারেন- আমি আকাশ থেকে একটু মাটিতে নামলাম । সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বলেন, সামাজিক কল্যাণের প্রশ্নে বলেন… একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে।”
একে/এম