মুহাম্মদ ফিরোজ মাহমুদ, মিরসরাইঃ কাউসার, রনি, মিনহাজ, ইমন, মেহেদী, নাজমুল, রিয়াদ, শাওন, আবির ও শাকিল তারা সবাই শিক্ষার্থী। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ বা কলেজে পড়াশোনা করেন। ২০১৫ সালে ১২ এপ্রিল একত্রিত হয়ে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ফেসবুকে গড়ে তোলেন ‘রক্তের বন্ধনে মিরসরাই’ নামে একটি অনলাইন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
প্রথমে এরা সংখ্যায় ৭-৮ জন থাকলেও এখন প্রায় অর্ধশতে পরিনত হয়েছে। মুমূর্ষকে রক্তদান, রক্ত যোগাড় করে দেয়ায় এখন তাদের নেশায় পরিনত হয়েছে। প্রতিদিন ৪-৫ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি। কিছুটা চ্যালেঞ্জিং তবু রক্তদাতা- গ্রহীতাদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করার এই কঠিন কাজই করার নেশা পেয়ে বসে তাদের মধ্যে। এদেশে রক্তের অভাবে আর কেউ মারা যাচ্ছে না, এই সংবাদটি যেদিন শোনা যাবে সেদিনই হবে এই তরুণদের স্বপ্নছোঁয়ার দিন।
জানা গেছে, মুঠোফোন বা ফেসবুক (রক্তের বন্ধনে মিরসরাই) পাতায় একজন মুমূর্ষু রোগীর খোঁজ পেলেই হলো। প্রাণসঞ্চারী রক্ত দিতে ছোটে তারা। শুধু কি তাই, অন্য রক্তদাতা সংগঠনগুলোর সঙ্গেও তাদের রয়েছে ভালো বোঝাপড়া। এক দল উদ্যমী তরুণ প্রায় ৩ বছর ধরে এভাবেই আর্তমানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে।
সংগঠনটির উদ্যোক্তাদের একজন নাজমুল হাসান। বারইয়ারহাট কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাজমুল বলেন, ‘মাসে আমরা ১০০ থেকে ১২০ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দিই। আমাদের সংগঠনের সবাই পরিবারের সদস্যদের মতো হয়ে গেছেন। ধর্মীয় ভেদ নেই। ’
একজন ব্যক্তির রক্তের প্রয়োজন হলে তিনি কিভাবে সহায়তা পেয়ে থাকেন জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, ‘রক্ত পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিতে হবে। এই পোস্ট পাওয়ার পর আমরা কিছু তথ্য চেয়ে রক্তের সন্ধানকারীর কাছে মেসেজ পাঠাই। সন্ধানকারীদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর রক্তের গ্রুপ উল্লেখ করে আমাদের বন্ধুদের কাছে তা পৌঁছে দিই। আমরা অ্যাডমিনরা সার্বক্ষণিকভাবে খবরাখবর রাখি। রক্তের সন্ধান পাওয়ার পর তা সরবরাহ করি। ’অনলাইনে অভ্যস্ত নন এমন ব্যক্তিদের কিভাবে সেবা দেওয়া হয় জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে আগ্রহী ব্যক্তিকে মোবাইল ফোনে সেবা দেওয়া হয়। ০১৮৪৬-৮৮৪৭০১ (কাউসার, সংগঠনের সভাপতি) নম্বরে ফোন করে রক্তের চাহিদা জানালেও আমরা সেবা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকি। ’
সংগঠনটির সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ মাহমুদ কাউসার। তিনি বলেন, “২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে উপজেলার মিঠানালা রামদয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে আমি নিজের উদ্যোগে একটি ব্ল্যাড ক্যাম্পের আয়োজন করি। এরপর চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যালের ছাত্র ফখরুল ইসলাম ইমন, চট্টগ্রাম সিটি কলেজের আশরাফ ভূঁইয়া, বারইয়ারহাট কলেজের মেহেদী হাসান, নাজমুল হাসান, আরাফাত আজিজ, শাকিল শাহব, ফেনী কলেজের রিয়াদ শাউন মিলে ‘রক্তের বন্ধনে মিরসরাই’ নামে ফেসবুকে একটি ফ্যান পেজের মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করি। সেই থেকে আমরা কোনো বিনিময় ছাড়া মুমূর্ষু রোগীদের জন্য রক্ত সরবরাহ করছি। সারা দেশে আমাদের রয়েছে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আমাদের নক করলেই আমরা সচেষ্ট হই রক্তের ব্যবস্থা করতে। ”
তিনি আরো বলেন, এই কাজে কোন ছুটির দিন নেই। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই রক্তের চাহিদা থাকে। যখন তখন ফোন আসে। পালা করে আমাদের কেউ না কেউ সারাদিন অনলাইনে এক্টিভ থাকেন। চাহিদা পাওয়া মাত্রই তা পূরণের জন্য তৎপর হয়ে পড়েন।
রক্তদান করা ছাড়াও অনলাইন ভিত্তিক এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্ল¬াড গ্রুপিং সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, অসহায় রোগীদের সাহায্য করা ইত্যাদি করে থাকে।
জানা গেছে, গরীব রোগী হলে অনেক সময় সংগঠনের সাথে জড়িতরা রক্তের ব্যাগও কিনে দেয়। তাদের পকেট থেকে জনপ্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকা তাঁরা খুশিমনে ব্যয় করে।
সংগঠনের সদস্য মেহেদী বলেন, খুব খারাপ লাগে রক্তের খোঁজে এসে যখন কেউ অন্য ধর্মাবলম্বীর রক্ত নিতে অপারগতা দেখিয়ে বিকল্প খুঁজতে অনুরোধ করেন। ‘জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম অথচ অন্য ধর্মাবলম্বীর রক্ত নিবেন না’ মানুষের এটা কেমন বিবেচনা, বুঝি না। এক্ষেত্রে ধর্মের যে কোন বিধি- নিষেধ নেই, আমাদের সকলকে তা বুঝতে হবে।
মজার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সংগঠনের সভাপতি ফরহাদ মাহমুদ কাউসার বলেন, তরুণদের অনেকেই এখন ১৮ বছর পূর্তি উদযাপন করেন রক্তদান করে। অনেক দম্পতি রক্তদানের মাধ্যমে বিবাহ বার্ষিকী পালন করেন। আমাদের সমাজে এই ধরণের চর্চা নিশ্চয়ই শুভ লক্ষণ।
উদ্যোক্তারা জানান, এ কর্মসূচি সফল করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। তবু রক্তদাতা-গ্রহীতাদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার এই কঠিন কাজ করার ‘নেশা’ পেয়ে বসে তাঁদের। ধীরে ধীরে এ কাজের সঙ্গে অনেকে একাত্মতা প্রকাশ করে। বর্তমানে এলাকার প্রতিটি হাসপাতাল, ক্লিনিকে এ সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের সব রকম তথ্য দেওয়া আছে। ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময় একটি ফোন করলে, মেসেজ পাঠালে অথবা ফেসবুকে জানালেই তাঁরা ছুটে যান রোগীর কাছে। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জোগাড় করে দেন রক্ত।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রনি বলেন, ‘এই কাজটি আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। বলতে পারেন নেশার মতো। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে নিজেরাই একটি ব্ল্যাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করব। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। ’
উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা সাবরিনা আক্তার লিনা বলেন, ‘এরাই বদলে দিতে পারে একটি সমাজ ও রাষ্ট্র। তাদের যেকোনো মহতী উদ্যোগে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর পাশে থাকবে। ’
Powered by : Oline IT