একদল ও এক ব্যক্তির শাসনের অবসানের মাধ্যমে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ‘ফিরিয়ে আনার’ সংগ্রামের জন্য নেতাকর্মীদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানো এবং তার পরের বছর সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থ হলেও এবার সফলতা আসবে বলে আশাবাদী বিএনপি চেয়ারপারসন।
রোববার বিকালে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে তিনি বলেন, “দেশে গণতন্ত্র নেই, দেশে নির্বাচন হয় না। আমরা আজকে বলতে চাই, আগামী দিনে যে কর্মসূচি আসবে সেজন্য সকলকে প্রস্তুত হতে হবে। আন্দোলন, সংগ্রাম ও নির্বাচন সবকিছুর জন্য আপনাদের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, “আপনাদের বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা আছে। আপনারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন। সেই স্বাধীন দেশ আওয়ামী লীগের পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী। বাংলাদেশকে তাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে।
“এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে হলে জেগে উঠতে হবে, সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল যারা আছেন, তাদের সকলকে আমি আহবান জানাবো, আসুন আমরা-আপনারা ভুক্তভোগী। তাই আমরা সকলে মিলে প্রতিবাদ করি, গণতন্ত্রের সংগ্রাম করি, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করি-এটাই হোক আমাদের শপথ।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভোটকেন্দ্রে জনগণকে আসতে দেয় না, তারা ভোটারবিহীন নির্বাচন করে। হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।
“আমাদের দাবি হচ্ছে, আগামী নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু করতে হলে শেখ হাসিনাকে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।”
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন সে বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধেই সংবিধান লংঘনের অভিযোগ করেছেন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, “সংবিধান তো তারাই লংঘন করেছেন। কারণ ১৫৪ জন বিনা ভোটে এমপি হয়েছেন। আর বাকীরা ৫ শতাংশও ভোট পায় নাই। এই সংসদ কি সংসদ আছে নাকি?“এই সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এই সংসদ নির্বাচিত নয়। এদের অধীনে নির্বাচন হতে পারে না, হবে না। সেজন্য নিরপেক্ষ সরকার দরকার। যেহেতু তারাই নির্বাচিত সরকার নয়, তাহলে তারা কী করে দাবি করবে যে, নির্বাচিত সরকার না হলে সংবিধান লংঘন হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরাই তো সংবিধান লংঘন করে ফেলেছে।”
বিজয় দিবস উপলক্ষে গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে এই সমাবেশ হয়। সারা দেশ থেকে আগত শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা এতে অংশ নেন।
মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ উপলক্ষে মহানগর নাট্যমঞ্চের মিলনায়তনসহ পুরো প্রাঙ্গণ ব্যানার-ফেস্টুন ও জিয়াউর রহমানের প্রতিকৃতি দিয়ে বর্ণিলভাবে সাজানো হয়।
সকালে অনুষ্ঠানস্থলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং সাত বীরশ্রেষ্ঠর স্মরণে সাতটি কবুতর মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধা দলের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
‘পার পেয়ে যাচ্ছে আ. লীগের অপরাধীরা’
শেখ হাসিনার প্রতি ইঙ্গিত করে খালেদা জিয়া বলেন, “একদলীয় বাকশালের দিকে দেশকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন এক ব্যক্তির শাসন চলছে। এক ব্যক্তি যা বলবেন সেটাই সবকিছু। তার নির্দেশই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সব জায়গায়। কাজেই আজকে আওয়ামী লীগের লোকজন যত অপরাধই করুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় না, তাদের কোনো শাস্তি হয় না।”
পক্ষান্তরে বিএনপি নেতাকর্মীরা কোনো অপরাধ না করলেও মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, “আমি আদালতে যাই, সেখান থেকে আমাদের কর্মীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারগুলো আমাদের কর্মী দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে।
“তারা (ক্ষমতাসীন) একতরফা সমাবেশ করছে। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে তারা সমাবেশ করতে দেবে না, ঘরের ভেতরেও দেবে না। এমনকি বিরোধী দল যারা আছে তারা দলের প্রোগ্রাম করতে চাইলে, সেটাও করতে দেবে না। এর নাম কি গণতন্ত্র?”
বিএনপি অশান্তি চায় না দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা চাই নির্বাচন করতে। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে চাই। আমরা আপনাদের মতো বিনা ভোটে নয়। কাজেই সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দিন এবং ঘরে-বাইরে উভয় জায়গায় সুযোগ দিন। আপনারা ভোট চাইছেন আর বিএনপি ঘরে বসেও সভা করতে পারবে না-এটা হতে পারে না। এসব বন্ধ করুন।”সরকার ‘জোর করে’ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে পদত্যাগ করিয়ে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ করেছে বলে অভিযোগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, “তিনি (বিচারপতি সিনহা) পদত্যাগ করতে চাননি। তাকে জোর করা হয়েছে, এমনভাবে তাকে ফোর্স করা হয়েছে তিনি বাধ্য হয়ে দিয়েছেন। এসবের সাথে সম্পূর্ণ সরকার জড়িত।এরা জুডিশিয়াল ক্যু করেছে। এরা তো অপরাধী। এই জুডিশিয়াল ক্যুর জন্য তাদের বিচার হওয়া উচিৎ।”
জনপ্রশাসনে সাম্প্রতিক পদোন্নতি নিয়ে তিনি বলেন, “আজকে সচিবালয়ে দেখেন কতজনকে রাতের অন্ধকারে প্রমোশন দেয়া হল। আজকে সেখানে সব দলীয় লোকজন। আর ভালো ভালো কর্মকর্তা যারা তাদের কিন্তু ওএসডি করে রেখে দেওয়া হয়েছে। ফলে এ রকম করে থাকতে থাকতে এক সময় তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
“শুধু তাই নয়, পুলিশ সার্ভিসেও একই অবস্থা। সেখানে সিনিয়র-জুনিয়র কিছুই মানা হয় না। সেখানে চলছে একতরফাভাবে সব কিছু। দলীয় ও নিজের নিজের দেশের (এলাকার) লোকজনকে ঢুকানো। ভালো অফিসারকে ভালো পোস্টিং দেওয়া হয় না, তাদের ওএসডি করে রাখা হয়। এভাবে একদিন তাদেরও বাড়ি চলে যেতে হয়।”
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না দাবি করে তিনি বলেন, “তারা সেই চেতনা বিশ্বাস করলে দেশে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করত না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র। সেজন্য সাধারণ মানুষ আজকে পরিবর্তন চায়। তারা দেশের ভালো কিছু দেখতে চায়।”নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন খালেদা।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ‘লুটপাট করে’ দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী করতে চায় তার একটি রূপরেখা ‘ভিশন-২০৩০’র কিছুটা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানের পরিচালনায় সমাবেশে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমেদ, বিএনপির খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুস সালাম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন এবং মুক্তিযোদ্ধা দলের মিজানুর রহমান খান, নজরুল ইসলাম খোকা, আবদুল মালেক খান, সামাদ মোল্লা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির সেলিমা রহমান, আহমেদ আজম খান, আমানউল্লাহ আমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল, ফজলুল হক মিলন, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, এম এ মালেক, শিরিন সুলতানা, মুক্তিযোদ্ধা দলের আবুল হোসেন, শাহ মো. আবু জাফর, আবু তালেব চৌধুরী, মোকসেদ আলী মুঙ্গলিয়া, মোজাফফর হোসেন, যুব দলের সাইফুল ইসলাম নিরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ছাত্র দলের রাজীব আহসানসহ অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
একে/এম